• বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন

বিয়ানীবাজারে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য

সামিয়ান হাসান / ১১ Time View
Update : রবিবার, ২৯ জুন, ২০২৫

শিক্ষাখাতে অস্বস্তি যেন কোনোভাবেই কাটছে না। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চড়ামূল্য আর অপরদিকে শিক্ষা উপকরণের আকাশচুম্বী দামে দিশেহারা অভিভাবক। এর মধ্যে কোচিং বাণিজ্য যেন অন্যরকম অভিশাপ হয়ে আমাদের সমাজে গেঁড়ে বসেছে। দুঃখজনক হলো, কোচিং বাণিজ্যের নেতৃত্বে দেয় আমাদের শিক্ষক সমাজ। যাঁরা সমাজের শিকড়ে গেঁড়ে বসা এ অসুখটিকে চিকিৎসা করার কথা, তাঁরা দিচ্ছেন এ শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণে নেতৃত্ব।

সাম্প্রতিক সময়ে বিয়ানীবাজারে উপজেলায় ও সরকারি কলেজের আশপাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত ব্যাপক হারে গড়ে উঠছে নামে বে-নামে একাদিক একাডেমিক কোচিং সেন্টার মাধ্যমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত যা কোচিং সেন্টার বানিজ্যে পরিনত হয়েছে। আর এসব কোচিং সেন্টারে অতিরিক্ত আয় করার আশায় স্কুল,কলেজ চলাকালীন সময়ে পড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষকরা।

একাধিক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট/কোচিং পড়ে। মেট্রোপলিটন, বিভাগীয় ও জেলা ও উপজেলায় এ হার সবচেয়ে বেশি। জরিপে আরও উঠে আসে যে, শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে না পড়লে নানা সমস্যায় পড়ে, এমনকি তারা ফেল করে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়ে, মানসিক নির্যাতন করে, বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে এক শ্রেণির শিক্ষকেরা তাঁদের কাছে পড়তে বাধ্য করছেন। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা।

বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মিলাদ মোহাম্মদ জয়নুল ইসলাম বলেন, আমি কোচিং বিরোধী। সরকার যখন সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে তখন থেকে আমি কোচিং এর বিরোধিতা করে আসছি। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতিটা হচ্ছে ক্লাসে পাঠ বুঝে নেয়া। কোন গাইড বা সাজেশন এর সহযোগিতা না নেওয়া। এটা নিলে ছাত্ররা গাইড নির্ভর ও কোচিংনির্ভর হয়ে যায় কোচিংয়ের শিক্ষকরা গাইড থেকে পাঠ দান করায়। আমি বলবো একজন ছাত্র যদি একটি পাঠ ঠিকমতো বুঝে নেয় তাহলে যেরকম প্রশ্ন আসুক না কেন সে উত্তর দিতে পারবে। বিয়ানীবাজারে ব্যাঙ্গের ছাতার মত কোচিং বাণিজ্য গড়ে উঠেছে এগুলো বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এছাড়া এই কোচিং ব্যবসার অন্তরালে নানা অনৈতিক কার্যকলাপেরও খবর পাওয়া গেছে। এজন্য সকল অভিভাবককে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ করছি।

অনুসন্ধানে আরো জানাযায় অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী নন। কোচিং বাণিজ্যেই তাঁরা অতি উৎসাহী। শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়া পর্যাপ্ত না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পরিচালিত কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। এতে দরিদ্র শ্রেণির অভিভাবকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আয়ের এক বড় অংশ সন্তানদের প্রাইভেট পড়াতে এবং শিক্ষার উপকরণ জোগাতে চলে যায়। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য থেকে জানা যায়, কোচিংয়ের কারণে বর্তমানে শিক্ষা ব্যয়ের সিংহভাগই রাষ্ট্রের পরিবর্তে পরিবারের ওপর বর্তাচ্ছে। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৯ ভাগ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ ভাগই পরিবার নির্বাহ করে। এ ব্যয়ের সিংহভাগই যায় কোচিং-প্রাইভেটের পেছনে। অভিভাকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা নিষিদ্ধ করে ২০১২ সালে ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা’ জারি করে, যা মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ নীতিমালা দেশের কোথাও মানা হচ্ছে না।
একাদিক অভিবাবক অভিযোগ করে বলেন কলেজে, স্কুলে যদি কঠোর ভাবে ক্লাস হতো তাহলে শিক্ষার্থীরা আর প্রাইভেট পড়তে হতো না, স্কুল কলেজে ক্লাস কম হয় বিদায় শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাদশ ও স্নাতক শিক্ষার্থীরা জানান আমাদের কলেজে ক্লাসে শিক্ষকরা ও শিক্ষার্থীরা সময় মত থাকেন না অনেকে বাহিরে সকালে কলেজ সময় চলাকালীন প্রাইভেট পড়তে চলে যায়, আমরা কলেজে আসি অপেক্ষা করি ক্লাস করবো কিন্তু অনেকে সকালে তাদের ক্লাস শেষ করে নেয় যার ফলে আমরা ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের পরিবারের যদি টাকা তাকতো তাহলে আমরা হয়তো এই ভাবে প্রাইভেট পড়তাম কলেজে স্কুলে ক্লাস করতাম না আমাদের টাকা নেই তাই কলেজে ক্লাস করার জন্য আসি।

বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে কোচিং নির্ভরতা রোধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: সাব্বির আহমদ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা—কলেজ চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী বা শিক্ষক, কেউই কোচিংয়ে যেতে পারবে না। কেউ গেলে তাকে অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সম্প্রতি কলেজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোচিংয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে—এমন অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি জানান, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে স্থানীয় প্রশাসন ও সচেতন মহলকে সঙ্গে নিয়ে কলেজ চলাকালীন সময়ে পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। অধ্যক্ষ আরও বলেন, “আমার শিক্ষকরা যদি কোচিংয়ে যুক্ত থাকেন, তবে তা করতে পারবেন শুধুমাত্র বিকাল ৪টার পর। কলেজ সময়ের মধ্যে নয়—এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।” কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে দাসউরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, শিক্ষা একটি সেবামূলক পেশা। যদি এ পেশা বাণিজ্যে পরিণত হয়, তাহলে সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। আমি অধ্যক্ষ সাব্বির আহমদের পদক্ষেপকে আন্তরিকভাবে সাধুবাদ জানাই। শিক্ষকদের উচিত শ্রেণিকক্ষে সময়মতো উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ পাঠদান নিশ্চিত করা। অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা দূর করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আস্থার জায়গায় পরিণত করতে হবে। এজন্য দরকার নীতিনিষ্ঠ শিক্ষক ও কঠোর প্রশাসনিক তৎপরতা।”

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুদ দাইয়ান বলেন, “শিক্ষার্থীদের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোচিংয়ে যাওয়া এবং কিছু শিক্ষকের এ সময় প্রাইভেট চর্চা নিঃসন্দেহে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হতাশাজনক। এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও আত্মনিরীক্ষা প্রয়োজন। অধ্যক্ষ সাব্বির আহমদের উদ্যোগকে আমরা শিক্ষক সমাজ হিসেবে স্বাগত জানাই এবং এর বাস্তবায়নে আমরা নৈতিক ও পেশাগতভাবে পাশে থাকবো।” সচেতন মহলের দাবী শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে না পারলে একটি সুসভ্য ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠন দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। তাই কোচিং বাণিজ্যের অবসান হওয়া খুবই জরুরি। বাণিজ্য বন্ধে শুধু আইন ও নীতিমালা করলেই চলবে না, চাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বছরের প্রথম মাস থেকেই শুরু হয় এসব প্রাইভেট বা কোচিং। অনেক অতি উৎসাহী অভিভাবক আবার তাঁদের সন্তানকে সকালে এক কোচিং এবং বিকেলে আরেক কোচিংয়ে পাঠান। তাই এই ক্ষতিকর প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগে কোচিং বাণিজ্য কঠোর হস্তে দমন করে শিক্ষকদের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিবোধের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে দুর্নীতির ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাবে আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category